কথা ছিল পাঁচটায়, কিন্তু রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তাতে নিদেনপক্ষে ঘণ্টাটাক সময় হাতে নিয়ে না বেরোলে কথা রাখা যাবে না। রাস্তায় নেমে এতক্ষণে চিন্তাটা একটু গুছিয়ে নিতে পারল রুবিনা। আজকাল এ নিয়ে একটা ভালো রকম সমস্যায় পড়তে হয়। সবকিছু কেমন অদ্ভুত জট পাকানো। এই অসহায় আত্মসমর্পণের জন্য টুকটাক মাশুল গুনতে হয়। কখনো অপরাধী সাজতে হয় অন্যের কাছে। এই যেমন একটু আগেও রিকশার জন্য অপেক্ষা করে করে যখন ক্লান্তির হাই উঠছে, হঠাৎ সেই ভাবনাটা শুঁড় তুলে তাকে নিস্তেজ করে দিল আমূল। অর্থাৎ শান্তিনগরের বাড়িটা দেখতে এখন তার যাওয়া হচ্ছে না। যদিও বিজ্ঞাপনের যোগাযোগ সূত্রে একটা মানুষ র্যাংকিন স্ট্রিট থেকে এসে তার জন্য অপেক্ষা করবে ঠিক পাঁচটায়, সে-মতোই পাকাপাকি কথা হয়ে আছে। অথচ এক নিমেষেই সেটা উড়িয়ে দিয়ে তাকে নিরুপায়ে ফিরে যেতে হচ্ছে নিজের ঘরে! এবং এটাই স্বাভাবিক নিয়মে যখন এগোনোর কথা, হঠাৎ লোকজনের জঞ্জাল ফুঁড়ে একখানা রিকশা এসে আচম্বিতে দাঁড়ায় তার সামনে। কোনো বাক্য না করে অনেকটা যন্ত্রবৎ সে উঠে বসে চক্রযানটিতে। হোক না সে যতই উল্টো পথের পথিক—এই ইচ্ছে পূরণের বাহনটা ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি তার নেই।
ঘেমে-নাওয়া চটচটে রোদেল বিকেলটা পাড়ি দিয়ে সে যত এগিয়ে যায় সামনের দিকে, একধরনের বিরুদ্ধ বাতাস ধীরে ধীরে ফেঁপে ওঠে তার অস্থির পালে। মনে হয় ফিরে যাই। ফিরে যাই। পথে পথে এত ঠাসা লোকজন, ধোঁয়াধুলো আর গাড়িবহরের জ্যামে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এতক্ষণে হাওয়া মরে গিয়ে রোদটা তেতে উঠছে আরও। হরতালের আগের দিন বলেই লোকজন ঝাঁপিয়ে নেমেছে রাস্তায়। বাসগুলো ক্রুদ্ধ মোষের মতো ছুটছে। গোঙাচ্ছে। পিঁপড়ের সারির ভঙ্গিতে এগোচ্ছে নানাবর্ণ গাড়ির মিছিল। এমন হা-ভাতে দেশে এত গাড়ির রোশনাই আসে কোত্থেকে! নতুন নতুন দালান আর বাহারি সাজের দোকানপাট দেখেও কম ছানাবড়া হচ্ছে না চোখ। আসলে কত দিন হলো এদিকে আসা হয় না। সেই কবে এসেছিল তাও বলতে হবে হিসাব করে।
রুবিনা ছোট্ট রুমাল বের করে মুখখানা মুছল। ভেতরে ভেতরে ঘেমে নেয়ে উঠেছে একদম। কোথাও নেমে একটু গলা ভেজাতে পারলে হতো। এই ভুলটা সে একদম করে না। আজ করল। যেখানে যায় পানির বোতলটা তুলে নেয় আলগোছে। আজ একটু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বেমালুম ভুলে গেছে এই পুরোনো অভ্যাসটা।
মগবাজারের বিরক্তিকর জ্যামে ফেরিওয়ালার কাছে এক বোতল ঠান্ডা পানি পেয়ে তার মনে আনন্দের নহর বয়ে গেল। কেননা, এই মুহূর্তে তেষ্টা নিবারণ ছাড়া তার দ্বিতীয় কোনো স্বপ্ন ছিল না। বোতলে মৃদু চুমুক দিয়ে শান্ত মনে সে কী যেন খুঁজল রাস্তার ওপাশটায়। হ্যাঁ, ওখানেই তো ছিল চশমার দোকানটা। ওখানে একজন ডাক্তার বসতেন। খুব হাসিখুশি ছিলেন মানুষটা। প্রথম যখন চোখে সমস্যা হলো, সমস্যা মানে বেশিক্ষণ পড়াশোনা করলে চোখে পানি এসে যেত, সেই সঙ্গে একটু ঝাপসামতো লাগত সামনের জিনিসপত্র। প্রথমদিকে এটাকে সে আমলের মধ্যে আনেনি। একদিন কথায় কথায় মামুনকে জানাল ব্যাপারটা। মামুন সবকিছুতে উতলা হতে ভালোবাসেন। ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করে বলেই ওর ভেতর একটা ডাক্তারি ভাব আছে। বউ এ ধরনের একটা রোগ চেপে রেখেছে দেখে তার বোধ হয় একটু আঁতে লাগল। চায়ে বড় চুমুক দিয়ে সে লাফিয়ে উঠল, ‘কুইক, ডাক্তার কিবরিয়ার ওখানে চলো। চেনা লোক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
ভয়ের কথা শুনে একটু হাসি পেলেও মুখে সেটা ফুটল না। তার ধারণা, ডাক্তারের কাছে চোখ নিয়ে গেলেই একটা চশমা ধরিয়ে দেবে। কেন যেন চশমায় তার বড় ভয়। মায়ের চশমাটা দু-একবার চোখে দিয়ে দেখেছে সকৌতুকে। তার চৌকো মুখখানা ঠিক দীপা ম্যাডামের মতো লাগে।
তখন তারা থাকে দিলু রোডে। ছোট্ট ছায়া ছায়া একটা ফ্ল্যাট। মাত্র দুখানা ঘর। পেছনে একচিলতে বারান্দা। ওই অতটুকু জায়গাতেই নানা রকম গাছ এনে পুঁতে দিয়েছে টবে। একটা আতা চারা দেখতে না দেখতেই লকলকিয়ে উঠল ডালপালায়। তার ছড়ানো ডাল একসময় গ্রিলের ফোকর পেরিয়ে মাথা উঁচাল আকাশের দিকে। প্রতিবার ফুল এলেও ফল ধরত না মোটেই। শুধু একবারই কী করে যেন টিকে ছিল একটা। সেই ফল নিয়ে যা মাতামাতি হয়েছিল ভাবতেও হাসি পায়। নেই নেই করে আরও কিছু ফুল আর বাহারি লতার গাছ খুব সাজ ধরেছিল সেই ছয়ছোট্ট বারান্দায়। একটা লালচে পাতার লতাকুমারী রাপুন-জেলের মতো লম্বা চুল খুলে দিয়েছিল নিচের বারান্দা অবধি। মিলু ভাবি হাসতে হাসতে বলতেন, ‘ভাগ্য একেই বলে, তুমি দাও পানি, আর আমি দেখি শোভা!’
শোভা কতটা ছিল কে জানে। তবে ওই একচিলতে বাগানের টানে ছোট্ট টুনটুনিদের দিনভর মেলা বসত সেখানে। সেই সাতসকালে এসে শুরু হয়ে যেত ওদের কলকাকলি। মামুন ছিল লেট-রাইজার। বালিশ মাথার ওপর চাপা দিয়ে সে বৃথাই ঠেকা দিত ওই খুশিতে মাতা খেলবাজ পাখিদের আওয়াজ। মুখে যতই বিরক্তির ভঙ্গি করুক, কেন যেন মনে হয় এই মুহূর্তটুকু ভেতরে ভেতরে ভারি উপভোগ করত মামুন। এই পোড়া শহরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে, এটা নিয়ে একটা চাপা অহংকার ছিল তার। বাসিমুখে চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রতিদিন বারান্দায় এসে একটু দাঁড়াত মানুষটা। শব্দ পেয়ে পাখিগুলো ফুড়ুত করে উড়ে পালাত দিগ্ববিদিক। ওর মুখে এ সময় একটু ছায়া পড়ত। অপরাধীর মতো মুখ করে বলত, ‘শোনো রুবি, আমাদের যখন নিজেদের বাড়ি হবে, দুটো কদমের গাছ এনে লাগিয়ে দেব বারান্দা ছুঁয়ে। তখন ওদের আর খেলতে অসুবিধা হবে না।’
একটু বোধ হয় আনমনা হয়ে গেছিল রুবিনা। ঘড়ির কাঁটা ধরে সে মোড়টার কাছে চলে আসতে পেরেছে দেখে ভালো লাগল। কী যেন দোকানটার নাম—হ্যাঁ, মনে পড়েছে—ফুড হ্যাভেন। এটাই ছিল মিটিং-পয়েন্ট। অবশ্য কয়েকজন মানুষ অলস দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। দু-একজন আবার কথাবার্তা বলছে নিজেদের মধ্যে। মোবাইলে সেভ করা ছিল নম্বরটা। কল দিতেই মৃদু হাসির আওয়াজ ঝংকৃত হলো কানের কাছে, ‘আমি তো আপনার পেছনেই দাঁড়ানো। ফিরে দেখুন।’
মানুষটার রসিকতায় একটু লজ্জিত হলো রুবিনা। তাই তো, এদিকটা তো নজরে আসেনি।
তা ছাড়া, তাকে চিনবেই বা কী করে!
হাসিখুশি মানুষটা এবার সপ্রতিভ গলায় বলল, ‘ভাগ্যিস, আপনাকে দাঁড় করিয়ে রাখিনি। খুব লজ্জার হতো তাহলে।’
রুবিনা অপরিচিতের ধাক্কাটা সামলে উঠেছে ততক্ষণে, ‘আপনি অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছেন বুঝি!’
‘আপনি সে সুযোগ দিলেন কই। ভাবলাম, জ্যামের সুবাদে দশ-বিশটা মিনিট আপনার এদিক-ওদিক হতে পারে। এই সুযোগে একটু মুখাগ্নি করে নিই...।’
পথ সামান্যই। কয়েক পা এগিয়ে গলিটার ভেতর ঢুকেই প্রথম বাড়িটা সদ্য তৈরি, পুরো কাজ হয়নি, এখনো। নিচের দিকটা পুরোপুরি অসম্পূর্ণ। তবে ফ্ল্যাটে লোকজন উঠে গেছে, যে যার মতো। ডেভেলপারের তৈরি বাড়ি যেমনটা হয়। ফেলো কড়ি, লও চাবি। এই ভদ্রলোকেরও এত দিনে চাবি পকেটে নেওয়ার কথা। কিন্তু মাথায় ঢুকেছে, ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে যে এক তোড়া টাকা পাবে, সেটা কানাডার পেছনে খরচ করলে আখেরে কাজ হবে। বুদ্ধিমানেরা এভাবেই হয়তো ঢিল ছোড়ে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও পা অন্তত গর্তে পড়ে না।
সিঁড়ি ভেঙে চারতলায় উঠতে হবে শুনে একটু থমকে দাঁড়াল রুবিনা। সে কিছুদিন ধরে হাঁটু-সমস্যায় ভুগছে। এখন অবশ্য এটা আমলে আনার কোনো মানে হয় না। ভবিষ্যতে লিফটের ব্যবস্থা হবে এটাই সান্ত্বনা।
সিঁড়িটা ধুলোবালিতে মাখামাখি হলেও এদিকে চোখ দেওয়ার তেমন প্রয়োজন মনে হলো না। এগারো শ দশ বর্গফুটের যে ফ্ল্যাটটি সে দেখতে এসেছে, এটা কতটা পছন্দ হবে, সেটাই সারকথা।
চারতলার বাঁ হাতের দরজাটার সামনে এসে মানুষটা থামল। বেশ কারুকার্যময় নকশি দরজা। সুদৃশ্য ডোর-ভিউর সঙ্গে যুক্ত নেমপ্লেট। মূল্যবান বিদেশি লক, হ্যান্ডেল। হাতলে আলতো স্পর্শ বুলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল মানুষটার পেছন পেছন। শুরুতে চোখ আছড়ে পড়ল ঘরের মাঝখানে দাঁড়ানো একটা সাদা চৌকো পিলারের দিকে। পুরো পিলারটাই ধবধবে টাইলসে মোড়ানো। এতে সৌন্দর্য বাড়লেও স্থায়ী এই দণ্ডটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে স্পেস বণ্টনে। খাবার টেবিল কোথায় বসবে, এ নিয়ে গম্ভীর পরামর্শ চলল দুই তরফে। কিন্তু কোনো স্থায়ী সুরাহা হলো না। মনটা বেজার হয়ে থাকল।
তবে বাকি আয়োজনটুকু একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। সাকল্যে তিনটা বেডরুম। দুটোতেই অ্যাটাচ বাথ। বাকিটা কমন। দুটো বারান্দা অন্য বাড়ির মুখোমুখি হলেও মন্দ নয়। পশ্চিম কোণের ঘরটিতে যেতে হয় একটা ছোট্ট করিডর পেরিয়ে। ভেতরে এসে জানালা ছুঁয়ে দাঁড়াল রুবিনা। এখান থেকে বেশকিছু গাছপালা চোখে পড়ছে। সবচেয়ে অবাক হলো, একটা কদমগাছ দেখে। চমৎকার ডালপালা আর সবুজ পাতায় ভরে আছে গাছটা। কদিন পর ফুল এলে একেবারে স্বর্গ হয়ে যাবে দৃশ্যটা। আর কী আশ্চর্য, রাজ্যের টুনটুনি এখনই মেতেছে সেখানে অপূর্ব ফুর্তিতে। এই আনন্দের মাঝে পিলারের খচখচানিটা দূর হয়ে গেল।
মানুষটা পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তার মুগ্ধতা লক্ষ করে এবার একটু মুখর হলো, ‘বাথরুমটা দেখেন। এর সব টাইলস কিন্তু এ গ্রেডের। রং আর ডিজাইনের কম্বিনেশনটা দেখেছেন? হাতিরপুলের দোকানে দোকানে ঘুরে আমার ওয়াইফ এসব পছন্দ করেছে। এখানে কোনো ফাঁকি পাবেন না...।’
‘হ্যাঁ, সেটা দেখেছি। ওনার রুচি আছে বটে।’
‘রান্নাঘরটাও ও মনের মতো সাজিয়ে নিয়েছে। ওখানের টাইলসের রংটা কিন্তু একটু অন্য রকম। লতাপাতার কাজটা দারুণ! এসব সাজাতে গিয়ে অনেক বাড়তি খরচ হয়ে গেছে। তবে শখের কাছে এটা কিছু না, কী বলেন?’ বক্তব্যের সমর্থনের আশায় সে তাকাল পার্শ্ববর্তিনীর দিকে।
রুবিনা তাকে নিরাশ করল না, ‘অবশ্যই। তবে এমন শখ করে সব বানিয়ে সেটা এখন ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? সরি, যদিও এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
মানুষটা এবার সরাসরি তাকাল তার মুখের দিকে। চোখটা আশ্চর্য রকম নিষ্প্রভ। মুখখানা ফ্যাকাশে। ঠোঁট দুটো দু মুহূর্ত কেঁপে থির হলো। ভেতরের ঝোড়ো হাওয়াটা শান্ত হওয়ার পর একটু সময় নিয়ে সে স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘যার জন্য এত শখ করে এটা নিয়েছিলাম, সে যখন নেই, তখন আর এ দিয়ে কী হবে!’
‘কেন কী হয়েছে ওনার!’ রুবিনার কণ্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ে।
‘ক্যানসার...। বহু চেষ্টা করেও লাভ হলো না ভেলোরে কিছুদিন রেখে ডাক্তার ছেড়ে দিল। মাঝখান থেকে ঋণ হয়ে গেল গুচ্ছের টাকা। এখন এই ঋণ শোধ দিতেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে ফ্ল্যাটটা...।’
রুবিনা এর উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না। সে জানালা গলিয়ে তাকিয়ে আছে কদমগাছটার দিকে। আর কদিন পরই বৃষ্টি এসে যাবে। তখন নিশ্চয় ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে গাছটা। এখানে দাঁড়িয়ে যে অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার কথা ছিল মহিলার, আজ তাকে চলে যেতে হয়েছে অজানা রাজ্যের ঠিকানায়। এভাবে হয়তো স্বপ্নগুলো ফুল হয়ে ফোটে, আবার ঝরেও যায় নিয়তির টানে।
এ এক অনন্ত খেলা। এর রহস্য বোঝার শক্তি তার মতো ক্ষুদ্রের নেই।
রুবিনা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল।
‘এ রকম একটা গাছের ভারি শখ ছিল ওর। ডালপালায় ঘেরা ছোট একটা ব্যালকনি। আর কিছু পাখি। ঠিক সেই দিলু রোডের প্রথম দিনগুলোর মতো...।’
‘বেশ তো, ওনাকে নিয়ে এলেই হতো। সেই ব্যালকনি, কদম, পাখি সবই তো এখানে আছে, যেমনটা চাইছিলেন।’
রুবিনার কানে কথাটা গেল কি না বোঝা গেল না। তখন অন্ধকার নেমে গেছে। আকাশটা থমথমে। বাতাস বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কালবৈশাখীর তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। এখনই না ফিরলে হয়তো আটকে যেতে হবে পথে।
রুবিনা অন্ধকারের মধ্যে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে বুঝল মানুষটা উত্তরের প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু এখন কোনো কথা বলার প্রবৃত্তিই তার নেই। তবুও ভদ্রতা বলে কথা। অস্ফুট স্বরে অনেক কষ্টে একটা কথাই বলতে পারল, ‘সে আর আসবে না।’
এরপর সেই আধো-আলোর প্রাচীর ভেঙে দুজন মানুষ অতি কষ্টে বেরিয়ে এল সেই জাদুকরি গুহার আগল খুলে।
এত সাবধানতার পরও সেই পিলারটায় মৃদু ধাক্কা খেল রুবিনা। মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে হাত না বাড়ালে হয়তো আছড়েই পড়ত মেঝেতে।
‘সরি, একটু সাবধানে পা ফেলবেন। আলোটালো নেওয়া হয়নি। বাইরে বোধ হয় লোডশেডিং শুরু হয়েছে।’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকই পারব।’
‘সিঁড়িতে কিন্তু রেলিং নেই। একটু দেয়াল ঘেঁষে নামবেন।’
‘আমাকে নিয়ে আপনার এত ভয় কেন? না-হয় আছড়ে পড়ে একটা পা-ই ভাঙবে। এর বেশি কিছু নয়তো!’
সিঁড়ির অনেকগুলো ধাপ এখনো বাকি। একটু সাবধানে পা না ফেলে উপায় নেই।
মোবাইলের আলো জ্বেলে এই অন্ধকারটুকু অনায়াসে দূর করা যায়। কিন্তু অনেক সহজ বুদ্ধিও অকারণই লোপ পায়। ঠিকঠাক মনে থাকে না।
মানুষটা এতক্ষণে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে মুখের সামনে ধরল, ‘সে আসবে না কেন, বললেন না তো?’
‘ সুইসাইড করেছে।’
‘সুইসাইড! কেন?’
‘ও যে মহিলাকে গোপনে ভালোবাসত সে ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর খুব আপসেট হয়ে যায়...।’
বাকি পথটুকু কেবলই সাড়াহীন। পা গুনে গুনে সিঁড়ি ভাঙা। নিজের শব্দে নিজেই চমকে ওঠা।
আলোর দেখা কখন মিলবে কে জানে!
ঘেমে-নাওয়া চটচটে রোদেল বিকেলটা পাড়ি দিয়ে সে যত এগিয়ে যায় সামনের দিকে, একধরনের বিরুদ্ধ বাতাস ধীরে ধীরে ফেঁপে ওঠে তার অস্থির পালে। মনে হয় ফিরে যাই। ফিরে যাই। পথে পথে এত ঠাসা লোকজন, ধোঁয়াধুলো আর গাড়িবহরের জ্যামে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এতক্ষণে হাওয়া মরে গিয়ে রোদটা তেতে উঠছে আরও। হরতালের আগের দিন বলেই লোকজন ঝাঁপিয়ে নেমেছে রাস্তায়। বাসগুলো ক্রুদ্ধ মোষের মতো ছুটছে। গোঙাচ্ছে। পিঁপড়ের সারির ভঙ্গিতে এগোচ্ছে নানাবর্ণ গাড়ির মিছিল। এমন হা-ভাতে দেশে এত গাড়ির রোশনাই আসে কোত্থেকে! নতুন নতুন দালান আর বাহারি সাজের দোকানপাট দেখেও কম ছানাবড়া হচ্ছে না চোখ। আসলে কত দিন হলো এদিকে আসা হয় না। সেই কবে এসেছিল তাও বলতে হবে হিসাব করে।
রুবিনা ছোট্ট রুমাল বের করে মুখখানা মুছল। ভেতরে ভেতরে ঘেমে নেয়ে উঠেছে একদম। কোথাও নেমে একটু গলা ভেজাতে পারলে হতো। এই ভুলটা সে একদম করে না। আজ করল। যেখানে যায় পানির বোতলটা তুলে নেয় আলগোছে। আজ একটু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বেমালুম ভুলে গেছে এই পুরোনো অভ্যাসটা।
মগবাজারের বিরক্তিকর জ্যামে ফেরিওয়ালার কাছে এক বোতল ঠান্ডা পানি পেয়ে তার মনে আনন্দের নহর বয়ে গেল। কেননা, এই মুহূর্তে তেষ্টা নিবারণ ছাড়া তার দ্বিতীয় কোনো স্বপ্ন ছিল না। বোতলে মৃদু চুমুক দিয়ে শান্ত মনে সে কী যেন খুঁজল রাস্তার ওপাশটায়। হ্যাঁ, ওখানেই তো ছিল চশমার দোকানটা। ওখানে একজন ডাক্তার বসতেন। খুব হাসিখুশি ছিলেন মানুষটা। প্রথম যখন চোখে সমস্যা হলো, সমস্যা মানে বেশিক্ষণ পড়াশোনা করলে চোখে পানি এসে যেত, সেই সঙ্গে একটু ঝাপসামতো লাগত সামনের জিনিসপত্র। প্রথমদিকে এটাকে সে আমলের মধ্যে আনেনি। একদিন কথায় কথায় মামুনকে জানাল ব্যাপারটা। মামুন সবকিছুতে উতলা হতে ভালোবাসেন। ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করে বলেই ওর ভেতর একটা ডাক্তারি ভাব আছে। বউ এ ধরনের একটা রোগ চেপে রেখেছে দেখে তার বোধ হয় একটু আঁতে লাগল। চায়ে বড় চুমুক দিয়ে সে লাফিয়ে উঠল, ‘কুইক, ডাক্তার কিবরিয়ার ওখানে চলো। চেনা লোক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
ভয়ের কথা শুনে একটু হাসি পেলেও মুখে সেটা ফুটল না। তার ধারণা, ডাক্তারের কাছে চোখ নিয়ে গেলেই একটা চশমা ধরিয়ে দেবে। কেন যেন চশমায় তার বড় ভয়। মায়ের চশমাটা দু-একবার চোখে দিয়ে দেখেছে সকৌতুকে। তার চৌকো মুখখানা ঠিক দীপা ম্যাডামের মতো লাগে।
তখন তারা থাকে দিলু রোডে। ছোট্ট ছায়া ছায়া একটা ফ্ল্যাট। মাত্র দুখানা ঘর। পেছনে একচিলতে বারান্দা। ওই অতটুকু জায়গাতেই নানা রকম গাছ এনে পুঁতে দিয়েছে টবে। একটা আতা চারা দেখতে না দেখতেই লকলকিয়ে উঠল ডালপালায়। তার ছড়ানো ডাল একসময় গ্রিলের ফোকর পেরিয়ে মাথা উঁচাল আকাশের দিকে। প্রতিবার ফুল এলেও ফল ধরত না মোটেই। শুধু একবারই কী করে যেন টিকে ছিল একটা। সেই ফল নিয়ে যা মাতামাতি হয়েছিল ভাবতেও হাসি পায়। নেই নেই করে আরও কিছু ফুল আর বাহারি লতার গাছ খুব সাজ ধরেছিল সেই ছয়ছোট্ট বারান্দায়। একটা লালচে পাতার লতাকুমারী রাপুন-জেলের মতো লম্বা চুল খুলে দিয়েছিল নিচের বারান্দা অবধি। মিলু ভাবি হাসতে হাসতে বলতেন, ‘ভাগ্য একেই বলে, তুমি দাও পানি, আর আমি দেখি শোভা!’
শোভা কতটা ছিল কে জানে। তবে ওই একচিলতে বাগানের টানে ছোট্ট টুনটুনিদের দিনভর মেলা বসত সেখানে। সেই সাতসকালে এসে শুরু হয়ে যেত ওদের কলকাকলি। মামুন ছিল লেট-রাইজার। বালিশ মাথার ওপর চাপা দিয়ে সে বৃথাই ঠেকা দিত ওই খুশিতে মাতা খেলবাজ পাখিদের আওয়াজ। মুখে যতই বিরক্তির ভঙ্গি করুক, কেন যেন মনে হয় এই মুহূর্তটুকু ভেতরে ভেতরে ভারি উপভোগ করত মামুন। এই পোড়া শহরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে, এটা নিয়ে একটা চাপা অহংকার ছিল তার। বাসিমুখে চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রতিদিন বারান্দায় এসে একটু দাঁড়াত মানুষটা। শব্দ পেয়ে পাখিগুলো ফুড়ুত করে উড়ে পালাত দিগ্ববিদিক। ওর মুখে এ সময় একটু ছায়া পড়ত। অপরাধীর মতো মুখ করে বলত, ‘শোনো রুবি, আমাদের যখন নিজেদের বাড়ি হবে, দুটো কদমের গাছ এনে লাগিয়ে দেব বারান্দা ছুঁয়ে। তখন ওদের আর খেলতে অসুবিধা হবে না।’
একটু বোধ হয় আনমনা হয়ে গেছিল রুবিনা। ঘড়ির কাঁটা ধরে সে মোড়টার কাছে চলে আসতে পেরেছে দেখে ভালো লাগল। কী যেন দোকানটার নাম—হ্যাঁ, মনে পড়েছে—ফুড হ্যাভেন। এটাই ছিল মিটিং-পয়েন্ট। অবশ্য কয়েকজন মানুষ অলস দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। দু-একজন আবার কথাবার্তা বলছে নিজেদের মধ্যে। মোবাইলে সেভ করা ছিল নম্বরটা। কল দিতেই মৃদু হাসির আওয়াজ ঝংকৃত হলো কানের কাছে, ‘আমি তো আপনার পেছনেই দাঁড়ানো। ফিরে দেখুন।’
মানুষটার রসিকতায় একটু লজ্জিত হলো রুবিনা। তাই তো, এদিকটা তো নজরে আসেনি।
তা ছাড়া, তাকে চিনবেই বা কী করে!
হাসিখুশি মানুষটা এবার সপ্রতিভ গলায় বলল, ‘ভাগ্যিস, আপনাকে দাঁড় করিয়ে রাখিনি। খুব লজ্জার হতো তাহলে।’
রুবিনা অপরিচিতের ধাক্কাটা সামলে উঠেছে ততক্ষণে, ‘আপনি অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছেন বুঝি!’
‘আপনি সে সুযোগ দিলেন কই। ভাবলাম, জ্যামের সুবাদে দশ-বিশটা মিনিট আপনার এদিক-ওদিক হতে পারে। এই সুযোগে একটু মুখাগ্নি করে নিই...।’
পথ সামান্যই। কয়েক পা এগিয়ে গলিটার ভেতর ঢুকেই প্রথম বাড়িটা সদ্য তৈরি, পুরো কাজ হয়নি, এখনো। নিচের দিকটা পুরোপুরি অসম্পূর্ণ। তবে ফ্ল্যাটে লোকজন উঠে গেছে, যে যার মতো। ডেভেলপারের তৈরি বাড়ি যেমনটা হয়। ফেলো কড়ি, লও চাবি। এই ভদ্রলোকেরও এত দিনে চাবি পকেটে নেওয়ার কথা। কিন্তু মাথায় ঢুকেছে, ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে যে এক তোড়া টাকা পাবে, সেটা কানাডার পেছনে খরচ করলে আখেরে কাজ হবে। বুদ্ধিমানেরা এভাবেই হয়তো ঢিল ছোড়ে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও পা অন্তত গর্তে পড়ে না।
সিঁড়ি ভেঙে চারতলায় উঠতে হবে শুনে একটু থমকে দাঁড়াল রুবিনা। সে কিছুদিন ধরে হাঁটু-সমস্যায় ভুগছে। এখন অবশ্য এটা আমলে আনার কোনো মানে হয় না। ভবিষ্যতে লিফটের ব্যবস্থা হবে এটাই সান্ত্বনা।
সিঁড়িটা ধুলোবালিতে মাখামাখি হলেও এদিকে চোখ দেওয়ার তেমন প্রয়োজন মনে হলো না। এগারো শ দশ বর্গফুটের যে ফ্ল্যাটটি সে দেখতে এসেছে, এটা কতটা পছন্দ হবে, সেটাই সারকথা।
চারতলার বাঁ হাতের দরজাটার সামনে এসে মানুষটা থামল। বেশ কারুকার্যময় নকশি দরজা। সুদৃশ্য ডোর-ভিউর সঙ্গে যুক্ত নেমপ্লেট। মূল্যবান বিদেশি লক, হ্যান্ডেল। হাতলে আলতো স্পর্শ বুলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল মানুষটার পেছন পেছন। শুরুতে চোখ আছড়ে পড়ল ঘরের মাঝখানে দাঁড়ানো একটা সাদা চৌকো পিলারের দিকে। পুরো পিলারটাই ধবধবে টাইলসে মোড়ানো। এতে সৌন্দর্য বাড়লেও স্থায়ী এই দণ্ডটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে স্পেস বণ্টনে। খাবার টেবিল কোথায় বসবে, এ নিয়ে গম্ভীর পরামর্শ চলল দুই তরফে। কিন্তু কোনো স্থায়ী সুরাহা হলো না। মনটা বেজার হয়ে থাকল।
তবে বাকি আয়োজনটুকু একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। সাকল্যে তিনটা বেডরুম। দুটোতেই অ্যাটাচ বাথ। বাকিটা কমন। দুটো বারান্দা অন্য বাড়ির মুখোমুখি হলেও মন্দ নয়। পশ্চিম কোণের ঘরটিতে যেতে হয় একটা ছোট্ট করিডর পেরিয়ে। ভেতরে এসে জানালা ছুঁয়ে দাঁড়াল রুবিনা। এখান থেকে বেশকিছু গাছপালা চোখে পড়ছে। সবচেয়ে অবাক হলো, একটা কদমগাছ দেখে। চমৎকার ডালপালা আর সবুজ পাতায় ভরে আছে গাছটা। কদিন পর ফুল এলে একেবারে স্বর্গ হয়ে যাবে দৃশ্যটা। আর কী আশ্চর্য, রাজ্যের টুনটুনি এখনই মেতেছে সেখানে অপূর্ব ফুর্তিতে। এই আনন্দের মাঝে পিলারের খচখচানিটা দূর হয়ে গেল।
মানুষটা পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তার মুগ্ধতা লক্ষ করে এবার একটু মুখর হলো, ‘বাথরুমটা দেখেন। এর সব টাইলস কিন্তু এ গ্রেডের। রং আর ডিজাইনের কম্বিনেশনটা দেখেছেন? হাতিরপুলের দোকানে দোকানে ঘুরে আমার ওয়াইফ এসব পছন্দ করেছে। এখানে কোনো ফাঁকি পাবেন না...।’
‘হ্যাঁ, সেটা দেখেছি। ওনার রুচি আছে বটে।’
‘রান্নাঘরটাও ও মনের মতো সাজিয়ে নিয়েছে। ওখানের টাইলসের রংটা কিন্তু একটু অন্য রকম। লতাপাতার কাজটা দারুণ! এসব সাজাতে গিয়ে অনেক বাড়তি খরচ হয়ে গেছে। তবে শখের কাছে এটা কিছু না, কী বলেন?’ বক্তব্যের সমর্থনের আশায় সে তাকাল পার্শ্ববর্তিনীর দিকে।
রুবিনা তাকে নিরাশ করল না, ‘অবশ্যই। তবে এমন শখ করে সব বানিয়ে সেটা এখন ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? সরি, যদিও এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
মানুষটা এবার সরাসরি তাকাল তার মুখের দিকে। চোখটা আশ্চর্য রকম নিষ্প্রভ। মুখখানা ফ্যাকাশে। ঠোঁট দুটো দু মুহূর্ত কেঁপে থির হলো। ভেতরের ঝোড়ো হাওয়াটা শান্ত হওয়ার পর একটু সময় নিয়ে সে স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘যার জন্য এত শখ করে এটা নিয়েছিলাম, সে যখন নেই, তখন আর এ দিয়ে কী হবে!’
‘কেন কী হয়েছে ওনার!’ রুবিনার কণ্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ে।
‘ক্যানসার...। বহু চেষ্টা করেও লাভ হলো না ভেলোরে কিছুদিন রেখে ডাক্তার ছেড়ে দিল। মাঝখান থেকে ঋণ হয়ে গেল গুচ্ছের টাকা। এখন এই ঋণ শোধ দিতেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে ফ্ল্যাটটা...।’
রুবিনা এর উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না। সে জানালা গলিয়ে তাকিয়ে আছে কদমগাছটার দিকে। আর কদিন পরই বৃষ্টি এসে যাবে। তখন নিশ্চয় ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে গাছটা। এখানে দাঁড়িয়ে যে অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার কথা ছিল মহিলার, আজ তাকে চলে যেতে হয়েছে অজানা রাজ্যের ঠিকানায়। এভাবে হয়তো স্বপ্নগুলো ফুল হয়ে ফোটে, আবার ঝরেও যায় নিয়তির টানে।
এ এক অনন্ত খেলা। এর রহস্য বোঝার শক্তি তার মতো ক্ষুদ্রের নেই।
রুবিনা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল।
‘এ রকম একটা গাছের ভারি শখ ছিল ওর। ডালপালায় ঘেরা ছোট একটা ব্যালকনি। আর কিছু পাখি। ঠিক সেই দিলু রোডের প্রথম দিনগুলোর মতো...।’
‘বেশ তো, ওনাকে নিয়ে এলেই হতো। সেই ব্যালকনি, কদম, পাখি সবই তো এখানে আছে, যেমনটা চাইছিলেন।’
রুবিনার কানে কথাটা গেল কি না বোঝা গেল না। তখন অন্ধকার নেমে গেছে। আকাশটা থমথমে। বাতাস বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কালবৈশাখীর তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। এখনই না ফিরলে হয়তো আটকে যেতে হবে পথে।
রুবিনা অন্ধকারের মধ্যে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে বুঝল মানুষটা উত্তরের প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু এখন কোনো কথা বলার প্রবৃত্তিই তার নেই। তবুও ভদ্রতা বলে কথা। অস্ফুট স্বরে অনেক কষ্টে একটা কথাই বলতে পারল, ‘সে আর আসবে না।’
এরপর সেই আধো-আলোর প্রাচীর ভেঙে দুজন মানুষ অতি কষ্টে বেরিয়ে এল সেই জাদুকরি গুহার আগল খুলে।
এত সাবধানতার পরও সেই পিলারটায় মৃদু ধাক্কা খেল রুবিনা। মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে হাত না বাড়ালে হয়তো আছড়েই পড়ত মেঝেতে।
‘সরি, একটু সাবধানে পা ফেলবেন। আলোটালো নেওয়া হয়নি। বাইরে বোধ হয় লোডশেডিং শুরু হয়েছে।’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকই পারব।’
‘সিঁড়িতে কিন্তু রেলিং নেই। একটু দেয়াল ঘেঁষে নামবেন।’
‘আমাকে নিয়ে আপনার এত ভয় কেন? না-হয় আছড়ে পড়ে একটা পা-ই ভাঙবে। এর বেশি কিছু নয়তো!’
সিঁড়ির অনেকগুলো ধাপ এখনো বাকি। একটু সাবধানে পা না ফেলে উপায় নেই।
মোবাইলের আলো জ্বেলে এই অন্ধকারটুকু অনায়াসে দূর করা যায়। কিন্তু অনেক সহজ বুদ্ধিও অকারণই লোপ পায়। ঠিকঠাক মনে থাকে না।
মানুষটা এতক্ষণে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে মুখের সামনে ধরল, ‘সে আসবে না কেন, বললেন না তো?’
‘ সুইসাইড করেছে।’
‘সুইসাইড! কেন?’
‘ও যে মহিলাকে গোপনে ভালোবাসত সে ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর খুব আপসেট হয়ে যায়...।’
বাকি পথটুকু কেবলই সাড়াহীন। পা গুনে গুনে সিঁড়ি ভাঙা। নিজের শব্দে নিজেই চমকে ওঠা।
আলোর দেখা কখন মিলবে কে জানে!