২৫মে,১১ জৈষ্ঠ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী পালিত হল।দেশের বিভিন্ন স্থানে কবি’র জন্মবার্ষিকীকে ঘিরে ছিল নানা আয়োজন।ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবির বাল্য ও কৈশোরের নানা স্মৃতি বিজরিত স্থান গুলোতেও চলছে বিভিন্ন আয়োজন।প্রতিবছর দরিরামপুর নজরুল মঞ্চে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান মালা আয়োজিত হলেও এবার হয়েছে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সে দিক দিয়ে নজরুল প্রেমীদের মাঝে একটা শুন্যতা বিরাজ করলেও নজরুলকে শ্রদ্ধা জানাতে ভুলে যায়নি এলাকার আবালবৃদ্ধবনিতা।চেষ্ঠা করেছেন নজরুলকে সকলের মাঝে যথাযথভাবে তুলে ধরতে।নজরুল আমাদের বিদ্রোহের কবি। তিনি কু-সংস্কার, অসুন্দর,অমানবিকতা,অবিচার,অসাম্য,শোষন,সংকীর্নতা,পরাধিনতা ও পশু শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।সাম্য,স্বাধিনতা ও মাতৃত্ববোধে তিনি ছিলেন এক মূর্ত প্রতীক।নজরুল তাঁর সঙ্গীতে,কর্মজীবনে,কাব্যে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্ঠা করেছেন।নজরুল ছিলেন এক অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী,আকাশের মত বিশাল ও উদার ক্ষনজন্মা পুরুষ।তাঁর আবির্ভাব ধুমকেতুর মতই তীব্র,বেগময় ও বর্নোচ্ছটাময়।তিনি বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি ও সঙ্গীতকার।নজরুলকে আমরা একক একটি নতুন সত্বা ও নতুন শক্তিরুপে দেখতে পেয়েছি।মাত্র ২২বছরের সাহিত্য সাধনায় কবি রেখে গেছেন বিশ্ব সাহিত্য ভান্ডারে অমুল্র সম্পদ।জাতির দুর্ভাগ্য যে মাত্র ৪২ বছর বয়সে এই অসামান্য প্রতিভার অধিকারী কবি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারান।সাহিত্যের বৈচিত্রতায় একাধারে তিনি কবি,উপন্যাসিক,প্রবন্ধকার,গল্পকার,অনুবাদক, অন্যদিকে তিনি একজন সফল চলচ্চিত্রকার,নাট্যকার,অভিনেতা,পরিচালক,গীতিকার,সুরকার ও নতুন নতুন রাগ রাগিনীর ¯্রষ্ঠাও।পাশাপাশি তিনি সাংবাদিক,রাজনীতিক ও সৈনিক ছিলেন।অলৈাকিক প্রতিভার অধিকারী এ কবি প্রতিকুলতাকে জয় করেই পৃথিবীতে আসেন।জন্মের পর থেকে নানা প্রতিকুল ও বৈরিতার ভিতর দিয়েই জাতির কাছে পৌঁঁছুতে সক্ষম হন।সংকীর্ন মহল শুরু থেকেই তার পিছু ছিল।তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িতার ধুঁয়া তুলে সমালোচনা করা হয়েছে ভুষিত করা হয়েছে দেশদ্রোহীর খেতাবেও।একদিকে তাঁেক যেমন মৌলবাদী হিসেবে দেখানোর চেষ্ঠা করা হয়েছে অপর দিকে মোল্লা মুন্সীরাও ধর্মদ্রোহী আখ্যায়িত করতে দ্বিধা করেননি।নজরুলের সৃষ্ঠিশীল সাহিত্য ও সঙ্গীতে সার্বজনিন সকল সম্প্রদায়ের কথাই তুলে ধরা হয়েছে গভীর মমত্ববোধের সঙ্গে।তাই তিনি ছিলেন সার্বজনিন কবি।সুখের কথা হচ্ছে তিনি দু’পক্ষেরই তালি ও গালি পেয়ে নিজের সার্বজনিন আসনকে পাকাপোক্ত করেছেন।নিজের স্বার্থ দেখার সুযোগ বা ফুরসৎ ছিলনা দারিদ্রতার অক্টোপাশে জড়িয়ে থাকা এ কবির।আজন্ম স্বাধিনতায় বিস্বাষী কবি সর্বদাই পাপ,পংকিলতা,জরাজির্নতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।নিশ্চল,স্থবির ও বিরাগী জীবন ধারায় নজরুল এক নবজীবন চেতনার নাম।তিনি বলেছিলেন অসাম্য ও ভেদ জ্ঞান দুর করতে আমি এসেছি।নজরুলের গান ও রচনাবলী সর্বদাই জাগ্রত করে মননশীলতাকে।একথা বলতে দ্বিধা নেই যে,বর্তমান সময়ের অসুস্থ মানষিকতা,বিকৃত রুচিবোধ অর্থ ও বর্নহীন সাহিত্য এবং সঙ্গীতে নজরুলের সৃষ্টি কর্মই একমাত্র অবলম্বন।যাকে আঁকড়ে ধরেই নতুন শতাব্দির নব প্রজন্মের নিকট বেঁচে থাকবে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভান্ডার।নজরুলের জীবনধারা ছিল বৈচিত্রতায় ভরপুর।তার সৃষ্টি কর্মের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন সঙ্গীতাঙ্গনকে নিয়ে। সঙ্গীত জগতে নজরুলের বিচরন ক্ষেত্রটি ছিল বিশাল।নজরুলের রচিত গানের সংখ্যা ৩হাজারের মতো।বিভিন্ন ধরন ও আঙ্গিকের গান তিনি রচনা করেছেন।নজরলের সমৃদ্ধ সঙ্গীতের ভুবনে প্রবেশ করলে অমরা পরিচিত হতে পারি রাগ প্রধান গান,গজল,কাব্য সঙ্গীত,প্রেমগীত,ঋতু সঙ্গীত,হাসির গান,খেযাল,কোরাস,গনসঙ্গীত,শ্রমিক-কৃষকের গান,শ্র্যমা সঙ্গীত,হিন্দি ,লোকধারার গান সহ আরো অনেক বৈচিত্রের গানের সঙ্গে।নজরুলের গানে বাংলা ছাড়াও উর্দু,ফারসি,হিন্দি ইত্যাদি ভাষার আগমন ঘটেছে।লোক সঙ্গীতে স্বদেশী সুর,বাউল,ভাটিয়ালী,ভাওয়াইয়া,ঝুমুর,লোকসুর,লোকগান,গনসঙ্গীত,মেয়েলি গীত,ছন্দ পেটানো গান,ইত্যাদির সংমিশ্রন রয়েছে।এ ছাড়াও নজরুলের বিখ্যাত লেটো গানতো আছেই।গ্রামীন জীবন ধারার কবি লেটো গান রচনা ও লেটো দলে যোগদান করে সাহিত্য জীবনের এক গুরুত্বপুর্ন অধ্যায় অতিক্রম করেছেন।মক্তবে শিক্ষকতা,মাজারে খাদেম,মসজিদে ইমামতি এমনকি গ্রামের মোল্লাগিরিও বাদ রাখেননি জীবনজিবীকার প্রয়োজনে।পারিবারিক অসচ্ছলতার কারনে লেটো দলে গান ও নাটক রচনা করেও তাকে অর্থ উপার্জন করতে হয়েছে।তখনকার সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তার লেটো গান ব্যাপক আলোড়ন তুলে এখনো অনেক এলাকায় এর প্রচলন বিদ্যমান।লেটো দলে তার কয়েকটি পালার মধ্যে রাজপুত্র,আকবর বাদশা,মেঘনাবদ কাব্য,আজব বিয়ে,চাষার সঙ ইতাদি।নজরুলের ঝুমুর আঙ্গিকে করা গানে প্রেমিকাকে প্রকৃতির সঙ্গে মিলানোর চেষ্ঠা করেছেন এ ভাবে ’এই রাঙ্গামাটির পথে লো মাদল বাজে বাজে বাঁেশর বাশী .....মন লাগেনা কাজে লো......রইতে নারী ঘরে ওলো প্রান হলো উদাসিলো...।তিনি লোক সঙ্গীতেও প্রকৃত সুরের দিকে গুরুত্ব দিতেন।বিদ্রোহী কবির ভিতর বাউলেরও যে বসবাস ছিল তার গান থেকেই তা স্পষ্ঠ হয়ে উঠে যেমন’মোরা ভাই বাউল চারন মানিনা শাষন বারন জীবন মরন মোদের অনুচররে.....।ভাটিয়ালী সুরে নজরুল লিখেছেন ”এ কুল ভাঙ্গে ও কুল গড়ে এই তো নদীর খেলা” অথবা কোন বিদেশের নাইয়া তুমি আইলা আমার গাঁও...লিখেছেন ’ও নাইয়া ধীরে চালাও তরনী.....।নজরুলের ’কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল করলে লোপাট রক্ত জমাট শিকল পূজোর পাষান .........গানটি কেবল ঔপনিবেশিক শক্তি বিরোধী আন্দোলনেই না প্রেরনা যুগিয়েছে আমাদের মহান মুক্তযোদ্ধেও।অলোক প্রতিভার চির বিদ্রোহের এ কবি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন প্রতিটি অন্যায় অত্যাচার ও জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে।আসবেন অসাম্য জাতি ভেদ কুসংস্কারের বিরোদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ নিয়ে।কবি বেঁচে থাকবেন ’মম এক হাতে বাঁকা বাঁেশর বাঁশরী আর হাতে রন তুর্য’ নিয়ে আমাদের শোনাবেন শিকল ভাঙ্গার গান।১১৩তম জন্মবার্ষিকীতে কবি ভক্তদের এটাই প্রত্যাশা।বিন¤্র ভক্তি ও শ্রদ্ধা জানাই বাংলার গানে বুলবুলের এ আগমনী দিনে।তিনি বেঁচে থাকুন ’চির উন্নত মম শীর নিয়ে’ সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে।তিনি বলেছিলেন ’আমি চিরতরে দুরে চলে যাব তবু আমারে দেবনা ভুলিতে’আজকের ক্ষনটিতে নতুন প্রজন্মের একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে আমরা কবিকে জানাতে চাই,হে চির বিদ্রোহের কবি আমরা তোমায় ভুলিনি এবং ভুলবওনা।তুমি বেঁেচ আছো এবং থাকবে।যেখানেই শোষন,অত্যাচার,নির্যাতন,নিপিড়ন,অজ্ঞতা,কু-সংস্কার,অসাম্যতা,জাতি,ধর্ম,বর্ন ভেদ সেখানেই তোমার বানীই এখনো একমাত্র চেতনা ও প্রেরনার উৎস।বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্ভারের এ কালজয়ী পুরুষ তোমাকে’জাতীয় কবি’ হিসেবে পেয়ে আমরাও গর্বিত ও উৎফুল্লিত।সৃস্ট্রিকর্তার প্রতি গভীর মমত্ববোধের প্রিয় কবি তোমায় লাখো সালাম।
লেখকঃ
কন্ঠ শিল্পী,
বাংলাদেশ বেতার,
শিক্ষক,সাংবাদিক
ও সাংস্কৃতিক সংগঠক
ভালুকা,ময়মনসিংহ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷